শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৫ই আশ্বিন ১৪৩০

ঢাকার হাটে বেপারীদের হাহাকার

ঢাকার উত্তরার বৃন্দাবন হাটে সোয়া ৩ লাখ টাকায় একটি গরু বিক্রি করে বেপারী আবদুর রহিম হা পিত্যেস করছিলেন এই বলে, “২৫ হাজার টাকা লস খাইলাম।”৮-৯ মণ ওজনের এই হরিয়ানা গরুটি কিনেছেন উত্তরা-৭ সেক্টরের বাসিন্দা আনিসুর রহমান। রহিম দাম হেঁকেছিলেন ৫ লাখ টাকা। কিন্তু আনিসুর আড়াই লাখ টাকা বলেন। তুমুল দরাদরির পর সোয়া ৩ লাখ টাকায় দফারফা হয়।

আনিসুর রহমান চলে যাওয়ার পরে বেপারি রহিম বলেন, “আমার গরুটা কি না ছিল সাড়ে ৩ লাখ টাকায়। “ তাহলে লোকসানে বিক্রি করলেন কেন- এ্ই প্রশ্নে তিনি বলেন, “কী করমু? গরু তো আর ফিরায়া নিতে পারমু না। এইবার সব গরুই প্রায় লস দিয়া বেচন লাগব।”

শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলা থেকে রহিমের মতো রাজধানীর অন্যান্য হাটে গরু নিয়ে আসা বেপারিরাও বলছেন, তারা এবার বড় ক্ষতির মুখে। এই বেপারীরা গরু কিনে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঢাকায় আনেন বিক্রির জন্য। বিক্রি না হলে সেগুলো ফেরত নিতে হলেও ট্রাক ভাড়া যায় অনেক, ফলে বিক্রি করে টাকা নিয়ে যাওয়াই তাদের লক্ষ্য।

করোনাভাইরাস মহামারীকালে অর্থনৈতিক সঙ্কট কিংবা স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে এবার ঢাকায় কোরবানি অনেকেই দিচ্ছেন না, ফলে গরু বিক্রিতে নেমেছে ধস।

বৃন্দাবন হাটে ফরিদপুর থেকে আসা বেপারি মো.হাশেম বলেন, “আমি একটা দেশি গরুর দাম চাইলাম ৮০ হাজার টাকা, দাম কইল ৪০ হাজার টাকা। গৃহস্থের ঘর থেকে গরুটা কিনতেও তো ৬০ হাজার টাকা লাগব।

“শেষ পর্যন্ত লসেই বেচা লাগব। কী আর করমু।”বৃন্দাবন হাটে কুষ্টিয়ার প্রাগপুর গ্রাম থেকে আসা বেপারী সিরাজুল ইসলাম জানান, গত শুক্রবার ৫টি দেশি গরু নিয়ে হাটে এলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত একটিও বিক্রি করতে পারেননি। তিনি বলেন, “আমি দাম বলি, ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা … আরা যারা কিনতে আসে তারা দাম কয় ৫০ হাজার, ৬০ হাজার টাকা। এত কম দামে গরু ছাড়া যায়?

“যদি এমন অবস্থা হয়, একটা গরুও বিক্রি করতে পারছি না, ফিরায়া নিয়া যাব। কিন্তু এত কমে না।”

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে আসা বেপারি কদম আলী ১২টি ষাঁড় নিয়ে এসেছিলেন বৃন্দাবন হাটে। মঙ্গলবার পর্যন্ত তিনি চারটি বিক্রি করতে পেরেছিলেন। কদম বলেন, যেসব ষাঁড় তিনি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে চেয়েছিলেন, সেগুলো বিক্রি করতে হয়েছে ৭০ হাজার টাকায়।

দেশি আবাল, দেশি শাহীওয়াল ক্রস, এরে- তিন ধরনের ৬০টি গরু নিয়ে পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটের কোরবানির হাটে এসেছিলেন কুষ্টিয়ার বেপারী মাসুদ রানা।

তিনি বুধবার বলেন, “বহু জন এসে দাম জিজ্ঞাসা করে চলে গেছে। কিন্তু কেউ কিনতে চায় না। একটা গরুও বিক্রি করতে পারিনি। কী করব আর! গরু মনে হয় ফিরায়ে নিয়ে যাব।’

পোস্তগোলা হাটে আসা কুষ্টিয়ার মোহাম্মদ মহসিন বলেন, “১০-১২টা গরু আনছিলাম। কিন্তু বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩টা। লাখের গরু ছাড়তে হইছে ৭০-৮০ হাজার টাকায়।”

উত্তরার বৃন্দাবন হাটের সায়িমা ডেইরি ফার্মের মালিক শামসুদ্দীন টগর বলেন, “২০০০ সাল থেকে গরুর ব্যবসা করছি। কিন্তু এমন খারাপ অবস্থা আর কখনও আসেনি।

“৪-৫ দিন হাটে আসছি, একটা গরুও বিক্রি করতে পারছি না। এবার ব্যবসা পুরোটাই লস বলা চলে। করোনাভাইরাস ধসিয়ে দিল এবারের ব্যবসা।”

অথৈ অ্যাগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “২৮টি গরু নিয়ে এসেছিলাম। মঙ্গলবার পর্যন্ত বিক্রি করলাম ২টা মাত্র। এভাবে চলতে থাকলে তো ব্যবসাই হবে না।

“যে দাম বলছি, ক্রেতারা তার ধারেকাছেও থাকছেন না। হাটের খরচটাও উঠে আসছে না।” ভাটারার ছোলমাইদ হাটে ২০টি ষাঁড় নিয়ে এসেছিলেন পাবনার আতাইকুলার আর এস আর অ্যাগ্রো ফার্মের খামারি জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বলেন, “আমাদের একেকটা ষাঁড়ের দাম পড়বে দেড় লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। কিন্তু ক্রেতারা যে দাম বলছেন, তাতে আমাদের পোষাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত গরু কিছু বিক্রি করতে পারব, আর কিছু পারব না।”

খিলক্ষেতের মাস্তুল হাটে বেপারী মেহেরপুরের শমসের আলী বুধবার বলেন, “মোটামুটি ২০ বছর ধরে ঢাকার হাটে আসি গরু নিয়ে। এমন খারাপ অবস্থা আর দেখি নাই।

“গরু আনা, হাটের পজিশন সব মিলায়ে খরচ হয়েছে ১২-১৩ লাখ টাকা। হাট থেকে ৫-৬ লাখ টাকাও যদি পাই, তাও বলতে পারতাম। কিন্তু এখনও তো গরুই বিক্রি করতে পারলাম না।”

উত্তর শাহজাহানপুর হাটের বেপারী পিজির মণ্ডল বলেন, “ম্যালা লসে গরু বিক্রি করতে হইতেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।”হাটে গরু বিক্রি না হওয়ায় এবার কোরবানির হাটের ইজারাদাররাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ গরু বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থের একাংশ থেকে তাদের আয় আসে।

উত্তরখানের মৈনারটেক হাটের ইজারাদার পারভেজ মিয়া জানান, এবার সাড়ে ৪ লাখ টাকা ইজারামূল্যসহ নানা ভ্যাট-ট্যাক্সসহ তাকে ১৫-১৬ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে কোরবানির হাটে।

“আমার হাটটা তেমন বড় নয়। মোটে ৫০০-৬০০ গরু আসছে। আজ (বুধবার) সকাল পর্যন্ত বিক্রি হইছে মাত্র ১৬টা গরু। এবার তো মনে হইতেছে, গজব নামছে। গত হাটে ৫ লাখ টাকা হ্যান্ড ক্যাশ লস হইছিল। এবার তো মনে হইতাছে, আরও লস হইবে।”কাওলার শিয়ালডাঙ্গা হাটের ইজারাদার রুবেল শওকত বলেন, “আমারে ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া লাগছে কোরবানির হাটের ইজারার জন্য। এখন গরু বিক্রি না হলে সেই টাকা কেমনে উঠাব? সব মিলায়ে তো মনে হইতাছে, এক কোটি টাকার গরুও বিক্রি হবে না এবারের হাটে। এ ক্ষতি কত বিশাল বোঝানো যাইব না।”

পূর্বাচলের মাস্তুলের হাটের ইজারাদার মাহমুদুল হাসান অসুস্থ থাকায় হাটের সার্বিক দেখভাল করছেন ৪৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শরীফুল ইসলাম ভুঁঞা।

তিনি বলেন, “৪০ লাখ টাকা ইজারাসহ ৫১ লাখ টাকা দিতে হয়েছে সিটি করপোরেশনকে। ১ কোটি টাকা লগ্নি আছে এই হাটের পেছনে। কিন্তু সেই টাকার কত পারসেন্ট উঠাতে পারব জানি না। গরু বিক্রিই তো নাই।”

এদিকে মহামারীর প্রভাবে গত বছরের তুলনায় এবার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কোরবানি কমতে পারে বলে ধারণা করছেন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাধারণ কাউন্সিলরা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান এবার উত্তর সিটি করপোরেশনের কোরবানির হাট পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছেন।

সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি বুধবার বলেন, “অন্যান্য বছর এ সময়ে বাসা বাড়িতে কোরবানির পশু চলে এলেও এবার তা দৃশ্যমান নয়। করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের হাতে টাকা পয়সাও খুব নাই। আগে যারা ২-৩ জন মিলে কোরবানি দিতেন, তাদের অনেকেই কোরবানি দিতে পারবেন না।

“আমার মনে হয়, গত বছরের তুলনায় আমার এলাকা মহাখালী-বনানীতে ৫০ পারসেন্টের কম কোরবানি হবে।”

মিরপুরের আহম্মদনগর, শাহআলীবাগ, দক্ষিণ বিশিল, পাইকপাড়া, টোলারবাগ এলাকাগুলোতে কোরবানি ঈদের তেমন প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না বলে জানালেন উত্তরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মুরাদ হোসেন।

“করোনাভাইরাসে কারণে মানুষের আর্থিক সামর্থ্য কমে গেছে। চারপাশে আগের মতো কোরবানির পশু দেখছি না। দুই-একটা বাড়িতে গরু দেখেছি। এলাকাবাসীর অনেকে এবার কোরবানি দিতে পারছেন না বলে জেনেছি।”রাজধানীর উত্তরার মোল্লারটেক, ইরশাল ও আজমপুর এলাকাতে কোরবানির তোড়জোড় শুরু হয়নি বলে জানান ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ডি এম শামীম।

“গতবারের তুলনায় এবারের ঈদে কোরবানি অনেক কমে যাচ্ছে। যারা একটু সামর্থ্যবান, তাদের অনেকেই এবার কোরবানি দিতে পারছেন না। বাসাবাড়িতে কোরবানির পশু রাখার জায়গাও নাই।” তবে ঈদের আগের দিন চিত্রটা একটু বদলাতে পারে বলে ধারণা শামীমের।

খিলগাঁও এলাকার কোরবানি ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে বলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহবুবুল আলম।

“এবার ৩০ শতাংশ কোরবানি কম হবে আমার এলাকায়, এমনটাই ধারণা করছি। আর্থসামাজিক অবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কথা চিন্তা করে অনেকেই কোরবানি দিচ্ছেন না।”

রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের কোরবানির প্রস্তুতি নিয়ে ডিএসসিসির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুলতান মিয়া বলেন, “অবস্থা খুব হতাশাজনক। কোরবানির হাটে গেলাম, সেখানে ক্রেতা দেখলাম না। মধ্যবিত্ত যারা তারা অর্থ সম্পদের কথা বিবেচনা করে, এবার কোরবানি দিচ্ছেন না অনেকে। আমার বাড়ির আশপাশেও কোরবানির প্রস্তুতি তেমন দেখছি না।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর সৌজন্যে

সংবাদটি আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন