শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৫ই আশ্বিন ১৪৩০

চলে গেলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মর্তুজা বশীর

জাগরণ ডেস্ক //

একুশে পদক প্রাপ্ত প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর মারা গেছেন। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ আগস্ট (শনিবার ) সকাল ৯টা ১০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন করোনা আক্রান্ত বরেণ্য এ শিল্পী। তার মেয়ে মুনীর বশীর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

মুনীর বশীর আরো জানান, শনিবার জোহর থেকে আসরের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে মুর্তজা বশীরকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

৮৮ বছর বয়সী এ চিত্রশিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের চিত্রকলার বিকাশে মুর্তজা বশীর যে অনন্য অবদান রেখেছেন তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে।

দীর্ঘদিন ধরেই হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন মর্তুজা বশীর। গত বৃহস্পতিবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে নেয়া হয়। তিনি সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শুক্রবার তার করোনা পরীক্ষা করা হলে ফলাফল পজিটিভ আসে।

বাংলার জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীর ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন।

চিত্রকলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে একুশে পদক পান তিনি। একই কাজে স্বাধীনতা পুরস্কার পান ২০১৯ সালে। কর্মজীবনে তিনি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

শুরুতে তিনি ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনে, এরপর বগুড়ার করোনেশন ইনস্টিটিউশন, ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস ও কলকাতা আশুতোষ মিউজিয়ামে শিক্ষাগ্রহণ করেন।

এছাড়াও ইতালির ফ্লোরেন্স একাডেমি দেল্লে বেল্লে আরতিতে চিত্রকলা ও ফ্রেস্কো বিষয়ে ও পরে প্যারিসের ইকোলে ন্যাশিওনাল সুপিরিয়র দ্য বোজার্ট এবং আকাদেমি গোয়েৎসে মোজাইক ও ছাপচিত্রে অধ্যয়ন করেন তিনি। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণে এক মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ৮টি রাজ্যের বিভিন্ন জাদুঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রদর্শন করেন তিনি।
পরে আইসিসিআর ফেলোশিপে তিনি ‘বাংলার শিল্প ঐতিহ্যের’র ওপর গবেষণার জন্য ভারতের বিভিন্ন জাদুঘর প্রদর্শন করেন। পরে ‘মন্দির টেরাকোটা শিল্প’ বিষয়েও তিনি ভারতে গিয়ে গবেষণা করেন।
১৯৫৫ সালে ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ড্রইং শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, প্রতিবাদে মুর্তজা বশীর ছিলেন অগ্রগামী। ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি আহুত ময়মনসিংহের হাজং, ভারতের তেলেঙ্গানা ও পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপে মুক্ত এলাকা দিবস এই প্রচার অভিযান চলছিল। ওই সময়ে গ্রেফতার হন মুর্তজা বশীর। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ মাস জেল খাটেন তিনি।
১৯৫২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের ওপর ‘পারবে না’ শিরোনামে তার কবিতা ছাপা হয়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একুশের স্মরণিকায় ‘ওরা প্রাণ দিল’ কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়।

১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে শহীদ আবুল বরকতকে রক্তাক্ত অবস্থায় অন্যদের সঙ্গে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যান। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন।
২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার ওপর ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শিরোনামে ১২৫২ সালে তিনি লিনোকোটে চিত্রটি আঁকেন, যা হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শীর্ষক সংকলনে ১৯৫৩ সালে প্রথম মুদ্রিত হয়। ‘রক্তাক্ত ২১’ কে ভাষা আন্দোলনের ওপর আঁকা প্রথম ছবি হিসেবে গণ্য করা হয় বলে এশিয়াটিক সোসাইটি জানিয়েছে।

১৯৭১ সালে ১৬ মার্চ শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত বাংলাদেশে চারু ও কারুশিল্পী পরিষদের উদ্যোগে ‘স্বা-ধী- ন-তা’ মিছিলে নেতৃত্ব দানকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মুর্তজা বশীর বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের আজীবন সদস্য।

এছাড়াও তিনি জাপানের ফুকুওকা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজ কমিটির নমিনেটর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কলা ও মানবিক গবেষণা মূল্যায়ন কমিটি ও কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নির্বাচন কমিটির সদস্য ছিলেন।

মুর্তজা বশীর ১৯৬২ সালে আমিনা বশীরকে বিয়ে করেন। তিনি দুই মেয়ে মুনীরা বশীর ও মুনিজা বশীর ও এক ছেলে মেহরাজ বশীর যামীর বাবা। ২০১৭ সালে স্ত্রী আমিনা বশীরকে হারানোর পর তিনি আমিনা বশীর স্মৃতি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন।

সংবাদটি আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন