এন্টিবডি কিট থেকে পাটকল

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
বেশ অনেকদিন হলো আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছি। তারপরও আমার সহকর্মীরা-যারা একসময় প্রায় সবাই আমার ছাত্র-ছাত্রী ছিল, তাদের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। আমি কারণে অকারণে তাদের ফোন করি তারাও নিয়মিত আমার খোঁজখবর নেয়। আজকাল জুম-মিটিং নামে এক ধরনের কায়দা বের হয়েছে সেটা ব্যবহার করে যারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যারা আমেরিকা-কানাডা অথবা ইউরোপে আছে কিংবা যে করোনা আক্রান্ত সন্দেহ করে আইসোলেশনে আছে, তাদের সবার সাথে একসঙ্গে গল্পগুজব করা যায়। একাধিকবার আমি সেভাবে তাদের সাথে রীতিমত আড্ডা দিয়েছি।
শেষবার তাদের সাথে কথা বলার সময় আমার একজন ছাত্রী আমাকে জানালো, “স্যার, ফেব্রুয়ারি মাসে আমার খুব বিচিত্র একটা অসুখ হয়েছিল, জ্বর, গায়ে ব্যথা, তার সাথে খুবই অদ্ভুত এক ধরনের কাশি। কাশতে কাশতে মনে হয় গলা থেকে রক্ত বের করে ফেলি কিন্তু একফোঁটা কফ নেই। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে খাবারে বিন্দুমাত্র স্বাদ পাই না, যেটাই খাই সব এক রকম মনে হয়।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার একার? নাকি বাসার সবার?” সে বলল, “বাসার সবার। এটা আমার হাজব্যান্ড ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিল, তারও হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ভুগেছেন আমার শাশুড়ি, তার নিউমোনিয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল তাই হাসপাতালে নিতে হয়েছিল।” আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলাম, “জ্বর নিয়ে ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলে?” সে মাথা নেড়ে বলল, “গিয়েছি। কলিগদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে।” কলিগ বলতে যাদের বুঝিয়েছে তারাও জুম মিটিংয়ে আছে আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম, তাদের তখন শরীর খারাপ হয়েছিল কীনা। তারা সবাই বললো, তাদেরও জ্বর কাশি হয়েছিল কিন্তু সেটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায়নি। বছরের এই সময় জ্বর-কাশি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বাংলাদেশে থাকবে আর সর্দি, জ্বর, কাশি হবে না সেটা তো হতে পারে না!
আমরা এখন যেসব উপসর্গকে করোনার ক্লাসিক উপসর্গ বলে জানি, আমার ছাত্রীর উপসর্গ তার সাথে হুবহু মিলে যায়। তাহলে আমরা কি সন্দেহ করতে পারি যে ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে আমার সেই ছাত্রী এবং তার পরিবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল? বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না গেলে করোনার উপসর্গ আর সাধারণ সর্দি-কাশি-ফ্লুয়ের উপসর্গের মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই। তারপরেও এটাকে বিচ্ছিন্ন কাকতালীয় একটা ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে পারি না তার কারণ আমি অনেকের সাথে কথা বলে জেনেছি তারা জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে করোনার উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল, তারা অবশ্যি সেটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায়নি। আমি নিজেও জানুয়ারির শেষে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়েছিলাম, “শুকনো কাশি” বলে নূতন একটা অবস্থার সাথে তখন পরিচয় হয়েছিল। জ্বরটির বৈশিষ্ট্য ছিল এক ধরনের অবিশ্বাস্য ক্লান্তি। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় শুয়ে মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। সুস্থ হওয়ার পর এক পার্টিতে সবাই যখন মজা করে কাবাব খাচ্ছে আমি তখন ঘ্যান ঘ্যান করে যাচ্ছি, “এটা কী রেঁধেছে? বিস্বাদ! মুখে দেওয়া যায় না।”
এখন সারা পৃথিবীর সবাই বলাবলি করছে ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে করোনার কথা জানাজানি হলেও এটা সম্ভবত ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে একবার “বিশ্বভ্রমণ” করে গেছে। ইতালি এবং স্পেনে বর্জ্য পানি পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারি মাসে হাজার হাজার মানুষ বই মেলায় গিয়েছে, সামাজিক দূরত্বের বিপরীত শব্দ হতে পারে, “অসামাজিক দূরত্ব” কিংবা “সামাজিক নৈকট্য”। “অসামাজিক দূরত্ব” কথাটা জানি কেমন অশালীন শোনায়, “সামাজিক নৈকট্য” মনে হয় মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটা শব্দ! বইমেলায় হাজার হাজার মানুষ এই সামাজিক নৈকট্যের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। কাজেই এটা মোটেও অস্বাভাবিক নয় যে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনার উপস্থিতি টের পাবার আগে আমাদের দেশে (কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে) করোনা একবার চক্কর দিয়ে অনেক মানুষকে তাদের অজান্তে আক্রান্ত করে গেছে।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
লেখক, পদার্থবিদ,বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ।